
কিন্তু পরিস্থিতি ভালো হলেও শিক্ষায় বিদায়ী বছরের ঘাটতি পোষানো হবে কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেছেন, ঘাটতিগুলো নিরূপণের জন্যই শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে তারা সামনে ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করবেন। তিনি বলেন, ‘কোথায় ঘাটতি হয়েছে সেটা বুঝতে পারবো বলে আশা করি। সে অনুযায়ী ২০২১ সালের সিলেবাস, কতটা রেমিডিয়াল ক্লাস নিবো সেটা তার ওপর নির্ভর করবে। শিক্ষার্থীদের যখন ক্লাসে আনবো তখনও নানা অ্যাসেসমেন্টের মধ্যে নিয়ে যাবো এবং ঘাটতি পূরণে সর্বোচ্চ করবো। হয়তো এক শিক্ষাবর্ষে ঘাটতি পূরণ করা যাবে না, সেক্ষেত্রে একাধিক শিক্ষাবর্ষ মিলিয়ে ঘাটতিগুলো পূরণের চেষ্টা করবো।’
এদিকে বিদায়ী বছরে যে এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি বিশেষ ব্যবস্থায় তার ফল প্রকাশ হবে জানুয়ারির শুরুতে। তবে পিছিয়ে যাবে ২০২১ সালের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা। এর মধ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের বই বিতরণ শুরু হয়েছে। যদিও সে বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা আবার কবে থেকে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারবে সেটি কারও জানা নেই।
সরকার গত মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর ঈদসহ নানা ছুটির কারণে মে মাস থেকে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কাজ শুরু করে অনেক স্কুল। পরে স্কুল কবে খুলবে তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় ঢাকার অনেকগুলো স্কুলে অনলাইনে শিক্ষাদান শুরু করলেও ঢাকার বাইরে যেখানে ইন্টারনেট আছে সেখানে রেকর্ডেড ক্লাসগুলোই পেয়েছে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা।
আকলিমা খাতুন বলছেন, শিক্ষক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা বলছে এতে ঠেকার কাজ চলেছে কিন্তু বাস্তবের তুলনায় এটি ছিলো খুবই স্বল্প পরিসরের উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘বাস্তবে তো পরীক্ষা নিতাম। এবার যারা ৪র্থ থেকে পঞ্চমে উঠলো তারা তো প্রশ্নের সাথে পরিচিতই হতে পারলোনা। সৃজনশীল যে প্রশ্ন তাদের দেখার কথা সেটি তারা দেখতেই পারেনি।
পুরো বছরে তাদের কোনো পরীক্ষাই হয়নি। ফলে এক বছর গ্যাপ দিয়ে যখন পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে তখন তাদের কাছে বোঝা হয়ে যাবে এটা।’ যদিও অনলাইনের পাশাপাশি টেলিভিশনে তৃতীয় শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদানের চেষ্টা হয়েছে। অনেক স্কুল আবার নিজেদের ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিনকার ক্লাসগুলো আপলোড করে দিয়েছে।
যদিও অনলাইন বা বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি সারাদেশর শতভাগ শিক্ষার্থীকে আনা যায়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই। ঢাকার একজন অভিভাবক তাহমিনা পলি বলছেন, তার দু’সন্তান স্কুলে পড়ছে। স্কুলগুলো অনলাইনে চেষ্টা করলেও এ বছর জানা উচিত ছিলো এমন অনেক কিছু অজানা রেখেই পরবর্তী শ্রেণীতে উঠতে হবে তাদের।তিনি, ‘পড়াশোনা পরীক্ষার পাশাপাশি কো কারিকুলাম কার্যক্রম থাকে সেগুলো থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে বাচ্চারা।
স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া যেটি আমার দুই বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে যতটুকু জানার কথা তা থেকে পিছিয়ে আছে। অনলাইনে হয়তো সিলেবাস শেষ করেছে কিন্তু সেটা করা হয়েছে বেছে বেছে। ফলে একটা পাঠের সাথে আরেকটার যে লিংক সেটা বাচ্চারা ধরতেই পারেনি অনেক ক্ষেত্রে।’ এদিকে ক্লাস পরীক্ষা না হওয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করে অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এবং সে কার্যক্রম এখন চলছে।
তবে অনলাইনের অপর্যাপ্ত শিক্ষাদান, শিক্ষকদের সাথে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া না থাকা, সিলেবাস অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পাঠ কার্যক্রম পরিপূর্ণ শেষ না হওয়ার জের ধরে প্রথম শ্রেণী থেক শুরু করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সর্বত্রই শিক্ষায় একটি বড় ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশংকা করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ক্লাসের বিষয় পুরোপুরি শেষ না করলে পরের ক্লাসে গিয়ে অনেক কিছুই বুঝবে না। না বুঝেই মুখস্থ করতে চাইবে। সব বিষয়ের মধ্যে আগের ক্লাস বা পাঠের সম্পর্ক থাকে। বলতে গেলে ২০২০ সালে যে যেই ক্লাসের সেই ক্লাসের যা শেখার কথা শিখলোনা। তো সে পরের বছর পরবর্তী ক্লাসে গিয়ে তো বুঝতে পারবেনা। এক পর্যায়ে হয় ড্রপ আউট হবে না হয় ফেল করতে করতে যাবে।’
আবার ২০২০ সালের শিক্ষায় এ ঘাটতির পাশাপাশি সামনে যোগ হবে ২০২১ সালের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর চ্যালেঞ্জ। আরেকজন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলছেন, ঘাটতি যাতে কম হয় সেজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এটি সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে ইন্টারনেট অবকাঠামো কিংবা নানা কারণে শিক্ষার্থীরাও অনেকে তার সুবিধা নিতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘একটা সিলেবাস কেন করা হয়। সে লেভেলে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে। পর্যালোচনা করে বিষয়গুলো সেখানে রাখা হয় যেটা তাদের প্রয়োজন বা বয়সের সাথে সম্পৃক্ত। এটা ভিত তৈরি করবে উপরের লেভেলে পড়াশোনা বা বোঝার জন্য। এটা তো বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষক যদি সব পূর্ণাঙ্গ কারিকুলাম না বোঝে তাহলে পরেও এই সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে কারণ পরিস্থিতি ভালো হলে স্কুল কলেজ খুললে শিক্ষককে আগে বুঝতে হবে যে শিক্ষার্থী আগের বছরে কোন বিষয়গুলো জানার সুযোগ পায়নি। তবে এজন্য খুলতে হবে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়।